দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মোটিভেশন

মিসর রাজ্যের প্রধান একবার এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। সে রাজ্যের জেলখানায় বন্দী থাকা এক যুবক সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা থেকে দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত পেয়ে রাজাকে অবহিত করেন। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাদশাহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। সেই কারাবন্দী যুবককেই তিনি রাজকোষের দায়িত্বশীল বানিয়ে দেন। এই যুবক ছিল ইউসুফ আলাইহিস সালাম। তিনি সাত বছর আগে থেকে খাদ্যশস্য মজুদ করে যথাযথ পন্থায় ফল-ফসল খরচ করার পদক্ষেপ নেন। যথাযথ পন্থায় সঞ্চয় ও পরিমিত খরচের ফলে রাজকোষ এখন খাদ্যশস্যে পরিপূর্ণ।
অন্যান্য রাজ্যের মত ফিলিস্তিনের কানআনেও দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। কানআনবাসী জানতে পারল, মিসর রাজ্যে বিভিন্ন এলাকার লোকদের রেশন দেওয়া হচ্ছে। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাই বড় ছেলেদের রেশন নিয়ে আসার জন্য মিসর প্রেরণ করেন। কিন্তু বিনইয়ামীনকে তাদের সঙ্গে পাঠাতে তাঁর মন সায় দেয়নি।
মিসর এসে ছেলেরা রাজকোষপ্রধানের দরবারে হাজির হয়ে রেশন প্রদানের আবেদন করেন। ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাদের চিনতে পারলেও তারা তাঁকে চিনতে পারে না। তিনি পরিচয় গোপন রেখে তাদের রেশন প্রদানের নির্দেশ দিয়ে দেন। কিন্তু শর্তারোপ করেন, এর পরের বার অপর ভাই বিনইয়ামীনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। শর্তানুযায়ী পরের বার বিনইয়ামীনকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বাবা হুঁশিয়ার করে দেন, বিনইয়ামীনের সঙ্গে যেন ইউসুফের মত ঘটনা না ঘটে। তিনি বিনইয়ামীনকে হারাতে চান না।
এদিকে এত বছর পর আপন ভাইকে দেখে ইউসুফ আলাইহিস সালাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সবার সামনে আবেগ গোপন রাখেন ঠিকই, কিন্তু একটি কৌশল অবলম্বন করে বিনইয়ামীনকে নিজের কাছে রেখে দেন। বাইরে প্রকাশ করেন যে, একটি বিশেষ অপরাধে তাকে বন্দি করা হচ্ছে।
বিনইয়ামীনের বন্দিত্বে ভাইয়েরা চিন্তায় পড়ে যান, বাবার কাছে কী জবাব দেবেন? কিন্তু বাবাকে জানানো ছাড়া আর কী-ইবা উপায় ছিল? ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফকে হারানোর দুঃখই ভুলতে পারেননি, বিনইয়ামীনের বন্দিত্বের খবর শুনে তিনি আরও ব্যথিত হন। কিন্তু তিনি নবীসুলভ দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ছেলেদের তিনি আবার মিসর ফিরে গিয়ে ইউসুফ ও বিনইয়ামীনকে খোঁজ করতে বলেন।২ তিনি তখন তাদের একটি মহামূল্যবান উপদেশ প্রদান করেন। এই উপদেশ মুমিনের হৃদয়ে খোদাই করে লিখে রাখার মত-
یٰبَنِیَّ اذْهَبُوْا فَتَحَسَّسُوْا مِنْ یُّوْسُفَ وَ اَخِیْهِ وَ لَا تَایْـَٔسُوْا مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِنَّهٗ لَا یَایْـَٔسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِلَّا الْقَوْمُ الْكٰفِرُوْنَ.
হে আমার পুত্রগণ! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইকে খোঁজ কর। আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় কেবল সেই লোকেরাই, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭
সেই কবে ইউসুফ আলাইহিস সালাম নিখোঁজ হয়েছেন। অপর ছেলে বিনইয়ামীন স্বয়ং রাজকোষপ্রধানের নির্দেশে কারাবন্দী। তার পরও ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলছেন, ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।’ এরপর আরও গভীর একটি বিষয়ের দিকে তিনি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন; মুমিনের চরিত্রে নিরাশা থাকতে পারে না, মুমিন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে পারে কেবল তারাই, যাদের মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস নেই’। কী দৃঢ় ঈমান আর গভীর বিশ্বাস আল্লাহর রহমতের প্রতি!!
আল্লাহ তাআলা নবীগণের হৃদয়ে অসীম ইয়াকীন ও বিশ্বাসের সম্পদ দান করেন। নবীগণের সীরাতের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি গভীর ও অটুট বিশ্বাসের অনন্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাই-
আদম আলাইহিস সালাম ইবলিসের চক্রান্তে জান্নাত থেকে হঠাৎ অজানা অচেনা পৃথিবীতে নেমে এলেন। কিন্তু তিনি একমনে আল্লাহর দরবারে দুআ করতে থাকেন এবং আপন দায়িত্ব পালনে রত থাকেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে রহমতের চাদরে আচ্ছাদিত করে নেন। [দ্র. সূরা বাকারা (২) : ৩৫-৩৭; সূরা আরাফ (৭) : ১১-২৫ ]
ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেটে কী গভীর বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকলেন। আল্লাহর রহমতে শেষ পর্যন্ত তিনি মাছের পেট থেকে জীবন নিয়েই বেরিয়ে আসেন। [দ্র. সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৭-৮৮]
ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে ফেলে দেওয়া হল। অদ্ভুত অবিচলতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও যাথাযোগ্য পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন তাঁকে সর্বসমক্ষে। চরম বিস্ময় নিয়ে নমরূদ ও নমরূদের গোষ্ঠী সেদিন দেখেছিল, আগুন ইবরাহীমের লেশমাত্র ক্ষতি করছে না। [দ্র. সূরা আম্বিয়া (২১) : ৬৮-৭০]
ফেরাউনের জুলুম থেকে বাঁচাতে মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়কে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে বেরিয়ে এলেন। ফিলিস্তিন যাওয়ার রাস্তা ছিল দুটি । স্থলপথ ও সমুদ্রপথ। স্থলপথে দূরত্ব কম, সমুদ্রপথে দূরত্ব বেশি। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম সমুদ্রপথ অতিক্রম করে যাওয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু ফেরাউনগোষ্ঠী তাদের গতিবিধি টের পেয়ে যায়। পিছনে ধাওয়া করে এসে সমুদ্র অতিক্রমের আগেই তাদের নাগাল পেয়ে যায়। বেগতিক অবস্থা দাঁড়ায় তখন- সামনে বিশাল সমুদ্র আর পেছনে শত্রুর বহর!! জুলুমের আশ্রয় নিয়ে বছরের পর বছর গোলামির জিঞ্জিরে আটকে রেখেছিল মিসরীয়রা বনী ইসরাইলকে। মূসার বদৌলতে গোলামির লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির যে আশাটুকু জেগেছিল তা-ও শেষ হয়ে গেল। হতাশার আওয়াজ শোনা গেল- ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম’। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম! লোহিত সাগরের তীরে তাঁর প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠ ধ্বনিত হল-
كَلَّا اِنَّ مَعِیَ رَبِّیْ سَیَهْدِیْنِ.
কিছুতেই নয়, আমার রব আমার সঙ্গে আছেন। তিনি অবশ্যই আমাকে পথ দেখাবেন। -সূরা শুআরা (২৬) : ৬২
মূসার রব সত্যিই মূসাকে পথ দেখিয়েছিলেন। সেদিন পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছিল, লোহিত সাগরের পানি দু’পাশে সরে গিয়ে মাঝখানে পথ তৈরি হয়ে গেছে!! [দ্র. -সূরা শুআরা (২৬) : ৬২]
আইয়ূব আলাইহিস সালাম দীর্ঘ অসুস্থতা সহ্য করে যাচ্ছিলেন। এত দীর্ঘ অসুস্থতায় সাধারণ কারো পক্ষে নিরাশ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি অনড় বিশ্বাস নিয়ে দুআ করে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একসময় তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁকে পূর্ণ সুস্থতা দান করেন। [দ্র. সূরা আম্বিয়া (২১) : ৮৩-৮৪]
যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সন্তান জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না তাঁর স্ত্রীর। একদিন মারইয়াম আলাইহাস সালামের কাছে গিয়ে দেখেন অসময়ের ফল। মৌসুম ছাড়া মৌসুমী ফল দেখে তার মনে জেগে ওঠে- আল্লাহ তো আপন রহমতে আমাকে এই অসময়েও সন্তান দান করতে পারেন। আল্লাহর দরবারে তিনি সন্তান প্রার্থনার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল সীমাবদ্ধতা দূর করে তাঁকে সন্তান দান করেন। [দ্র. সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩৭-৪১]
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে যাওয়ার সময় কাফেররা ছাওর গুহার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে আবু বকর রা. কিছুটা চিন্তিত হন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন শান্ত সমাহিত। পূর্ণ ইয়াকীনের সঙ্গে তিনি অভয় জানালেন-
لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللهَ مَعَنَا.
উদ্বিগ্ন হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। -সূরা তাওবা (৯) : ৪০
ইয়াকুব আলাইহিস সালামের নববী প্রজ্ঞাময় উপদেশ ও কর্মনীতি এবং উপরিউক্ত অন্যান্য নবীগণের ঘটনাবলি থেকে আমরা শিক্ষা পাই, মুমিনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল, আল্লাহর রহমতের আশা ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা। বরং প্রত্যাশা ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাই মুমিন জীবনের একমাত্র অবলম্বনীয় ও করণীয়।
জীবনে আমরা নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হই। শত আকাক্সক্ষা ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অপ্রাপ্তির বেদনা আমাদের আশাহত করে। দীর্ঘ অসুস্থতা ও জটিল রোগ-ব্যাধিতে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। সমাজের অন্যায়, অনাচার ও অবিচার আমাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। কখনো বিপদের প্রবল ঝড় আমাদের স্বপ্নের পৃথিবী তছনছ করে দিয়ে যায়। প্রত্যাশার শেষ রশ্মিটুকু মুছে গিয়ে জীবনে নেমে আসে হতাশার ঘন কালো অন্ধকার। কুরআন কারীম তখন প্রত্যাশার আলোকবর্তিকা হয়ে আমাদের পথের দিশা দেয়। নিরাশার সব অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠে কুরআনের দীপ্ত-মশাল-
لَا تَایْـَٔسُوْا مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِنَّهٗ لَا یَایْـَٔسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ اِلَّا الْقَوْمُ الْكٰفِرُوْنَ.
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় কেবল সেই লোকেরাই, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না। [সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭]
Leave a Reply