হুসনে যন’: ইসলামে আশাবাদের উৎসমূল

প্রতিদিন আমরা যে শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠি, তা আগের দিনের শরীরের থেকে কিছুটা ভিন্ন। রাতের বেলা কয়েকটি চুল ঝরে পড়ে, নখ অল্প বাড়ে, ত্বক, হাড় ও পেশির কোষ মরে যায় এবং নতুন কোষ জন্ম নেয়। এই পরিবর্তন শুধু শারীরিক নয়।
আল্লাহর অসীম দয়ায় রাতের ঘুমে আমাদের আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় দেহ থেকে এবং সকালে ফিরে আসে। ফিরে আসা আত্মাটিও পুরোপুরি এক থাকে না—বরং আগের দিনের ঘটনার প্রভাবে বেড়ে ওঠে বটে, তবে একটুখানি পরিপক্ব হয় এবং তার নতুন তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ধরনে বদল ঘটে।
এই পরিবর্তন, এই অস্থায়ী প্রকৃতি, এসবই দুনিয়ার একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আমাদের শরীর, আত্মা, পরিবেশ, সম্পর্ক এবং আর্থিক অবস্থা—সবকিছু প্রতিদিন বদলায়। যেন সব কেমন খেলার মতো করে প্রকৃতিতে ঘুরছে এবং বদলে বদলে এইখানে ওইখানে যাচ্ছে।
কোরআনে আল্লাহ যেমন বারবার উল্লেখ করেছেন, ‘এবং পার্থিব জীবন কেবল খেলাধুলা ও বিনোদন; কিন্তু আখিরাতের আবাস তাদের জন্য উত্তম, যারা আল্লাহকে ভয় করে। তবে কি তোমরা বোঝ না?’ (সুরা আন’আম, আয়াত: ৩২)
‘হুসনে যন’ কী
‘হুসনে যন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘সুধারণা’ বা ‘ভালো চিন্তা রাখা’। এটি এমন এক অভ্যাস, যা আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি বজায় রাখতে উৎসাহিত করা হয়। আমরা যখন কোনো মুসলিমকে ভালো কিছু করতে দেখি, তখন তাদের প্রশংসা করব। আর যখন তাদের কোনো কাজ ভুল বলে মনে হবে আমাদের চোখে, কিন্তু স্পষ্ট কারণ কারণ জানা থাকবে না, তখন তাদের জন্য অজুহাত তৈরি করব। চেষ্টা করব নেতিবাচক ধারণা না পোষণ করতে।
‘হুসনে যন’ আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করে এবং মিথ্যা অভিযোগ বা আস্থার ক্ষতি থেকে বাঁচায়। ইসলামে গীবত বা অপবাদ একটি বড় পাপ, ‘হুসনে যন’ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে আমরা এই পাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব। আমরা যদি অন্যের ভালো দিকগুলোর ওপর ফোকাস করি, তাহলে তা আমাদের সঙ্গীদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে শক্তি জোগাবে।
আল্লাহর প্রতি ‘হুসনে যন’
দেখা যায়, আমরা আমাদের ভাইবোনদের জন্য সুধারণা রাখার অজুহাত ঠিকই তৈরি করি, কিন্তু জীবন যখন আমাদের ইচ্ছেমতো চলে না বা দোয়া আমাদের প্রত্যাশামতো কবুল হয় না, তখন আল্লাহর প্রতি নেতিবাচক ধারণা করে বসি। মনে করি আল্লাহ আমাদের ভালোবাসেন না বা আমাদের ডাক শুনছেন না।
অথচ আল্লাহ বলেন: ‘যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, [হে মুহাম্মদ], তখন বলো, আমি নিকটেই আছি। যে আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই। তাই তারা যেন আমার আনুগত্য করে এবং আমার ওপর ইমান আনে, যাতে তারা সঠিক পথে থাকে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে তিনি শোনেন এবং সাড়া দেন। তিনি আমাদের ভ্রমণের সময়, রোজার অবস্থায় বা বৃষ্টির সময় দোয়া কবুলের বিশেষ সুযোগ দিয়েছেন। এর মানে এ নয় যে তিনি আমাদের ইচ্ছেমতো ফলাফল দেবেন। আল্লাহ বলেন:
‘হয়তো তোমরা যা অপছন্দ কর, তা তোমার জন্য কল্যাণকর; আর যা ভালোবাস, তা ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)
‘হুসনে যন’ মানে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা যে তিনি পূর্ণাঙ্গ চিত্রটি দেখেন, যা আমরা দেখি না। আমরা যে চাকরির জন্য প্রার্থনা করছি, হতে পারে তা হারাম আয়ের দিকে নিয়ে যাবে। যাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি, সে দুঃখের কারণ হবে।
মুসা (আ.)-এর ঘটনা এর একটি ভালো উদাহরণ। তিনি সবকিছু হারানোর পর নির্দিষ্ট কিছু না চেয়ে বলেছিলেন, ‘হে আমার রব, তুমি আমার জন্য যা কল্যাণ পাঠাবে, আমি তার মুখাপেক্ষী।’ (সুরা আল-কাসাস, ২৮:২৪)
এটিই আল্লাহর প্রতি হুসনে যন। মুসা (আ.) বিশ্বাস করেছিলেন যে আল্লাহ তার জন্য কল্যাণ চান। তিনি শুধু কল্যাণ চেয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাকে বিয়ে, কর্মসংস্থান ও নতুন আশ্রয়, সবই দিয়েছিলেন।
সাহাবাদের মধ্যে ‘হুসনে যন’
সাহাবাদের জীবনী পড়লে দেখা যায়, প্রত্যেকে ইসলামের প্রথম দিনগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। খাব্বাব (রা.)-এর মতো কেউ কেউ ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। তার মনিব তার পিঠে জ্বলন্ত কয়লা রেখেছিল, যা তার দেহের মাংস গলিয়ে দিয়েছিল। অন্যরা আর্থিক, পারিবারিক বা সামাজিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন।
কিন্তু সাহাবাদের মধ্যে কোনো ঈর্ষা বা অন্যের পরীক্ষাকে ‘সহজ’ মনে করার মনোভাব ছিল না। তারা পরস্পরের সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন, যা হুসনে যনের একটি ভিন্ন রূপ—বিশ্বাস করা যে প্রত্যেকের পরীক্ষা তার জন্য উপযোগী।
‘হুসনে যন’ হলো ইসলামি আশাবাদের একটা চিত্র। যেকোনো পরীক্ষা আসুক না কেন, আমরা আমাদের মুসলিম ভাইবোন সম্পের্ক সুধারণা রাখব, তাদের সেরা গুণগুলোর ওপর ফোকাস করব এবং আল্লাহর ওপর অটল ভরসা করে যাব।
Leave a Reply