কোরআনের কথা

পৃথিবীর বাদশাহ

হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তখন মক্কায়। কাফেররা তাঁর নবুওয়াতের সত্যতা যাচাই করতে চাইল। মদিনার ইহুদিদের কাছে প্রতিনিধি দল পাঠাল। প্রতিনিধি দল তাদের কাছে মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে জানতে চাইল। ইহুদিরা প্রতিনিধি দলকে তিনটি প্রশ্ন শিখিয়ে দিয়ে বলল, এগুলোর উত্তর সত্য নবী ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল ‘ওই ব্যক্তির অবস্থা বলুন, যে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত জয় করতে করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।’ প্রশ্নগুলোর জবাবে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর সুরা কাহাফ নাজিল হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৩/২১-৭২)

ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আল্লাহ-তায়ালা নবীকে বললেন, ‘তারা তোমাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, আমি তোমাদের কাছে তার বিষয় বর্ণনা করব।’ (আল্লাহতায়ালা বলেন,) ‘আমি তো তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৮৩-৮৫)

জুলকারনাইন ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দেশসমূহ জয় করেছিলেন এবং সেসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য অর্জনে আল্লাহর কাছ থেকে সব রকম উপায়-উপকরণ পেয়েছিলেন। তিনি দিগ্বিজয়ে বের হয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্তে পৌঁছে ছিলেন—পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শেষে প্রান্তে এবং উত্তরে পর্বতমালার পাদদেশে। পাশ্চাত্যে তিনি এক অবিশ্বাসী সম্প্রদায় পেলেন। তিনি বললেন, ‘আমি এদের প্রথমে দাওয়াত দেব। যারা সৎ পথে আসবে, তাদের প্রতিদান দেব। যারা কুফুরে রয়ে যাবে, তাদের শাস্তি দেব।’

প্রাচ্যে এমন এক সম্প্রদায় পেলেন, যারা শূন্য ময়দানে থাকত। রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গৃহ, তাঁবু, পোশাকপরিচ্ছদ ব্যবহার করত না। দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে এমন এক সম্প্রদায় পেলেন, যারা তার কথা বুঝতে পারছিল না। তারা তাঁর কাছে ইয়াজুজ-মাজুজ থেকে বাঁচার আকুতি জানাল। তিনি দুই পর্বতের মধ্যবর্তী গিরিপথকে একটি সুবিশাল লৌহ প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ফলে ইয়াজুজ-মাজুজের লুটতরাজ থেকে এলাকার জনগণ রক্ষা পায়। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ৮৩-৯৭; তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ৮১৮)

কোরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন কে এবং কোন যুগে ছিলেন, এ সম্পর্কে ইসলামি গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম রাজি (রহ.)-এর মতে, জুলকারনাইনের প্রকৃত নাম সিকান্দার। তিনি দারা ইবনে দারাকে একাধিকবার পরাজিত করেছেন। সিকান্দারের বাবা ছিলেন ইবনে ফিলিবুস ইউনানি।’ (তাফসিরুল কাবির, খণ্ড: ২১, পৃষ্ঠা: ৪৯৩)

ইবনে ইসহাকের বরাতে ইমাম কুরতুবি (রহ.) উল্লেখ করেছেন, ‘জুলকারনাইন ছিলেন মিসরের অধিবাসী। তিনি ইউনান বিন ইয়াফেস বিন নুহ (আ.)-এর সন্তান। ইবনে হিশাম বলেছেন, তার নাম সিকান্দার।’ (তাফসিরুল কুরতুবি, ১১/৪৫)

ইবনে কাসিরের মতে, জুলকারনাইনের সময় ছিল সিকান্দার গ্রিক, মকদুনি থেকে দুই হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আমলে। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন হজরত খিজির (আ.)। তিনি পদব্রজে হজে গেলে ইবরাহিম (আ.) মক্কা থেকে বের হয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান, তাঁর জন্য দোয়া করেন এবং উপদেশ দেন। ইবনে কাসিরে আজরকির বরাত দিয়ে আছে, জুলকারনাইন ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তওয়াফ ও কোরবানি করেন।

আবু রায়হান আল-বিরুনি কিতাবুল আসারিল বাকিয়া আনিল কুরুনিল খালিয়াতে বলেন, ‘কোরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন হচ্ছে আবু বকর ইবনে সুমাই ইবনে ওমর ইবনে আফরিকায়স হিমইয়ারি। তিনি দিগ্বিজয়ী ছিলেন।’

আবু হাইয়ান বাহরে মুহিতে বলেন, জুলকারনাইন তিনজন ইয়েমেনি সম্রাটের প্রথম সম্রাট ছিলেন। সাবা কূপের মোকদ্দমায় ইবরাহিম (আ.)-এর পক্ষে ন্যায় সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।’ (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মূল: মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা: ৮১৯)

জুলকারনাইন নবী ছিলেন না। তিনি ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘জুলকারনাইন একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/ ১১৩)। আবু হুরায়রাহ (রা.)-ও জুলকারনাইনকে সৎকর্মপরায়ণ বান্দা মনে করতেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/ ১০৩)। আলি (রা.) বলেন, ‘জুলকারনাইন নবীও ছিলেন না, বাদশাহও ছিলেন না; তিনি একজন সৎ বান্দা ছিলেন।’ (ফাতহুল বারি, ৬/ ২৯৫)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *