ব্যস্ত জীবনেও কোরআন খতম: একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা

ব্যস্ত জীবনেও কোরআন খতম: একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা
“ভাই, এক মুহূর্তও সময় নেই!”—এই কথাটি আজ আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা কেউ কর্মজীবী, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ পরিবারের দেখভালে নিয়োজিত; আমাদের প্রত্যেকের কাঁধেই রয়েছে শত দায়িত্বের ভার। এই চিরচেনা ব্যস্ততার ভিড়ে আত্মা প্রশান্তকারী কোরআনের জন্য সময় বের করা কি আসলেই সম্ভব?
উত্তরটি হলো—হ্যাঁ, শুধু সম্ভবই নয়, বরং এটি আমাদের অপরিহার্য প্রয়োজন। আর এর জন্য দরকার শুধু একটু ইচ্ছা, কৌশল আর আল্লাহর ওপর ভরসা।
কেন কোরআনের সঙ্গে আমাদের থাকা প্রয়োজন?
কোরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি আত্মার খোরাক। যখন জীবন এলোমেলো মনে হয়, মন থাকে বিষণ্ণ, তখন কোরআনের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করলে বা শুনলে যে ঐশী প্রশান্তি মেলে, তার কোনো তুলনা হয় না। যাঁরা সরাসরি স্রষ্টার বাণী পাঠ করতে পারেন, তাঁদের সৌভাগ্য সত্যি ঈর্ষণীয়।
এই তেলাওয়াতের পুরস্কারও সীমাহীন। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করবে, সে একটি নেকি পাবে। আর প্রতিটি নেকি দশ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। আমি বলি না যে ‘আলিফ-লাম-মিম’ একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মিম একটি হরফ।” (সুনানে তিরমিজি: ২,৯১০)
প্রতিটি হরফে এত বিশাল পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি আমাদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা।
কত দিনে কোরআন খতম করা উত্তম?
কোরআন খতমের ক্ষেত্রে ভারসাম্য জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) খুব দ্রুত খতম করতে নিরুৎসাহিত করেছেন, কারণ তাতে এর মর্ম বোঝা যায় না। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি তিন দিনের কমে কোরআন খতম করে, সে তা উপলব্ধি করতে পারে না।” (সহিহ বুখারি: ৫,০৫৪)
সাহাবিদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) প্রতি সাত দিনে একবার কোরআন খতম করতেন, যা সর্বোত্তম অভ্যাস হিসেবে বিবেচিত। (সহিহ মুসলিম: ৮১৮)
তবে আমাদের মতো ব্যস্ত মানুষের জন্য বছরে অন্তত একবার খতম করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন কেবল একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা।
ব্যস্ততার ফাঁকে কোরআন খতমে্র ৫টি কৌশল
আপনার দৈনন্দিন রুটিনের ফাঁকেই লুকিয়ে আছে কোরআন খতমের সুযোগ। আসুন, কিছু কৌশল জেনে নিই:
১. ভ্রমণের সময়টুকু হোক ইবাদত:
অফিসে বা অন্য কোনো কাজে যাওয়ার পথে বাস, গাড়ি বা রিকশায় আমরা প্রায়ই ফেসবুক বা রিলস স্ক্রল করে সময় নষ্ট করি। এই ১৫-২০ মিনিট সময়টুকু যদি কোরআন তেলাওয়াত বা অডিও তেলাওয়াতে ব্যয় করা যায়, তাহলে অনায়াসেই কয়েক পৃষ্ঠা পড়া হয়ে যায়। মনে রাখবেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ করা।” (তিরমিজি: ২৩১৮)
২. কর্মবিরতিতে ১০ মিনিটের বরকত:
অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে বা জোহরের নামাজের পর মাত্র ১০-১৫ মিনিট সময় বের করা কঠিন কিছু নয়। এই ছোট্ট সময়ে কোরআনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন আপনার বাকি দিনের কাজেও বরকত এনে দিতে পারে, ইনশা আল্লাহ।
৩. দিনের শেষ হোক স্রষ্টার কথায়:
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফোনের স্ক্রিনে চোখ না রেখে রাসুল (সা.)-এর সুন্নত পালনে সুরা মুলক পড়ুন। (তিরমিজি: ২,৮৯২) এর সঙ্গে আরও একটি বা দুটি পৃষ্ঠা যোগ করে নিলে আপনি খতমের পথে অনেকটাই এগিয়ে যাবেন।
৪. ভোরের প্রশান্তিতে কোরআনের আলো:
ফজরের পরের সময়টি বরকতময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতের জন্য দোয়া করে বলেছেন, “হে আল্লাহ, আমার উম্মতের সকালকে বরকতময় করুন।” (সুনানে আবু দাউদ: ২,৬০৬) এই সময়ে মাত্র ১০-২০ মিনিট তেলাওয়াত করলে দিনের শুরুটাই হবে প্রশান্তিময় এবং ফলপ্রসূ।
৫. একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা:
কোরআনে প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠা রয়েছে।
প্রতিদিন মাত্র ২ পৃষ্ঠা পড়লে: ৩০০ দিনে, অর্থাৎ এক বছরেরও কম সময়ে একবার খতম সম্ভব।
প্রতিদিন ৫ পৃষ্ঠা পড়লে: বছরে তিনবার কোরআন খতম করাও সম্ভব!
এর জন্য দৈনিক মাত্র ১৫-২০ মিনিট সময়ই যথেষ্ট। আপনার অগ্রগতি ট্র্যাক করতে Tarteel বা Quran Companion-এর মতো অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনাকে লক্ষ্যে স্থির থাকতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “দুটি নিয়ামত আছে, যে বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ প্রতারিত হয়—সুস্থতা ও অবসর।” (সহিহ বুখারি: ৬,৪১২)
ব্যস্ততা আমাদের জীবনের বাস্তবতা, এটি কখনো শেষ হবে না। তাই সময় বের হবে—এই অপেক্ষা না করে, আমাদেরকেই সময়ের ভেতরে কোরআনের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে। প্রতিদিনের একটু একটু প্রচেষ্টা মিলেই একদিন বিশাল অর্জনের রূপ নেবে। আপনার এই পথচলা আল্লাহ সহজ করে দিন, ইনশা আল্লাহ।
Leave a Reply