সমস্যায়–সংকটে ইসলামে মুক্তির দিশা

জীবন একটি পরীক্ষার মাঠ। কিছু পরীক্ষা একটু সহজ; যার সমাধানের আশা আছে। কিন্তু যে পরীক্ষায় পড়লে কোনো শেষ নেই বলে মনে হয়, সেগুলোর সঙ্গে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব? যে পরীক্ষা সারাজীবন চলতে পারে, তার সঙ্গে আমরা কীভাবে শান্তি স্থাপন করব?
আসলে ভাগ্য একটি রহস্য, যা বেশিরভাগ মানুষের বোধগম্য নয়। এটা ঠিক যে, আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে এবং আমাদের পছন্দের জন্য আমরাই দায়ী। কিন্তু আসলে আমাদের ইচ্ছাশক্তি সীমিত এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। তিনি সবকিছু জানেন এবং আমাদের ভাগ্য লিখে রেখেছেন।
যখন আমরা এমন পরীক্ষার সম্মুখীন হই যার শেষ নেই, তখন সবচেয়ে ভালো কাজ হলো কদর বা ভাগ্যকে মেনে নেওয়া। এটি ইমানের অংশ। ইমানে মুফাস্সালে তাই আমরা পড়ি: আমানতু বিল্লাহি…ওয়াল কাদরি খইরিহি ওয়াশাররিহি মিনাল্লাহি তাআলা (অর্থাৎ, আমরা ইমান এনেছি…ভালো বা মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত)।
জীবনে কেউই পরীক্ষা ছাড়া পার পায় না। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রাখ, যা তোমার জন্য ছিল না, তা তোমাকে পেতে হবে না; আর যা তোমার উপর এসেছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়।’ (ইমাম নববির ৪০ হাদিস, হাদিস: ১৯)
তবে এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতে পড়লে আমরা কিছু কাজের মধ্য দিয়ে শান্তি খুঁজে পেতে পারি।
আখিরাতে মনোনিবেশ
কষ্টের একটি নেয়ামত হলো, তা আমাদের আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়। মনে করিয়ে দেয় যে, এই দুনিয়ার জীবন সংক্ষিপ্ত এবং শীঘ্রই আমরা সবাই চলে যাব। তখন কেবল আমাদের সৎ কাজ এবং নিয়ত আমাদের সঙ্গে যাবে। ফলে একটি ট্র্যাজেডি হতে পারে আমাদের চিন্তাভাবনাকে পুনর্বিন্যাস করার সুযোগ। ভাবতে হবে, জীবন যতই কঠিন হোক, যদি আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলি, তবে ফলাফল হলো জান্নাত—যেখানে আর কোনো কষ্ট থাকবে না এবং দুনিয়ার সব কষ্টের মূল্য আমরা সেখানে পাব।
আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসা
আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং তাঁর ইচ্ছা আমাদের জন্য সর্বোত্তম। তাঁর পরিকল্পনার ওপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। ইউসুফ (আ.) কারাগারে, আইয়ুব (আ.) অসুস্থতায় এবং ইউনুস (আ.) মাছের পেটে থেকেও আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছিলেন। ‘আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন’ এই চিন্তাই আমাদের পথ দেখাতে পারে। কখনো কখনো পরীক্ষা আসে আমাদের জীবন মান আরো উন্নত করার জন্য। আমরা জানি আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসা রাখলে শেষ ফলাফল আমাদের পক্ষে হবে।
মুসা (আ.) এবং খিজিরের কাহিনির কথা চিন্তা করুন। নৌকার মালিক, যারা তাদের সন্তান হারিয়েছেন এবং এতিমরা যারা তাদের উত্তরাধিকার পায়নি—তারা জানত না যে এই ট্র্যাজেডিগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের জন্য। আল্লাহর পরিকল্পনা এমনভাবে কাজ করে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তাই যখন জীবন কঠিন হয়, তখন তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে শান্তি খুঁজুন।
ধৈর্যের বিকল্প নাই
ধৈর্য ধারণ করাও বিপুল সওয়াবের কারণ। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। তাই ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হলো ধৈর্য ধরা। ধৈর্য মানে নিষ্ক্রিয়ভাবে নিপীড়ন সহ্য করা নয়; বরং নিয়ন্ত্রণের বাইরে যা আছে তা মেনে নেওয়া। এর আরেকটি মানে হলো, আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা এবং গুনাহের ইচ্ছা থাকলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। ধৈর্য বিশ্বাসীর জীবনধারার অপরিহার্য উপাদান।
জীবন কঠিন হয়ে উঠলে পরীক্ষার চেয়েও বেশি শক্ত হতে হবে আমাদের। আল্লাহর সন্তুষ্টিকে রাখতে হবে একমাত্র লক্ষ্য।
কষ্টে স্বস্তি খোঁজা
জীবন খুব কঠিন হয়ে গেলে দুটি পথ খোলা থাকে: নিজেদের জন্য দুঃখ করা এবং হাল ছেড়ে দেওয়া, অথবা এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করা। প্রথমটিতে কোনো লাভ নেই। পরাজয় বিশ্বাসীর জন্য উপযুক্ত নয়। বরং আমরা সহ্য করব এবং এগিয়ে যাব। কষ্টের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে নেব। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয় কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি।’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত: ৫)
তাই কঠিন সময়েও জীবনের ভালো জিনিসগুলো খুঁজে বের করুন এবং তা থেকে সান্ত্বনা নিন। পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে শান্তি খুঁজুন। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে ইবাদত এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজুন। আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক আমাদের কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে।
আশা না হারানো
আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে কেবল কাফিররাই নিরাশ হয়।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৭)
আশা হারানো যাবে না কখনো। ভালো বা খারাপ সব সময়ে আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের দেখছেন। সবকিছু তাঁর ইচ্ছায় ঘটে। আমাদের প্রচেষ্টার ফল যদি দুনিয়াতে নাও পাই, আখেরাতে নিশ্চয় পাব। বিশ্বাসীরা কখনো আল্লাহর রহমতের উপর আশা হারায় না। তারা জানে যে, অলৌকিক ঘটনাও ঘটা সম্ভব।
আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি সচেতন থাক, তিনি তোমার দেখাশোনা করবেন। তাঁর কাছে সাহায্য চাও। জেনে রাখো, পুরো জাতি তোমাকে সাহায্য করতে চাইলেও আল্লাহ না লিখলে কেউ কিছু করতে পারবে না এবং তারা তোমার ক্ষতি করতে চাইলেও আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছু করতে পারবে না। কলম উঠে গেছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে।’ (ইমাম নববির ৪০ হাদিস, হাদিস: ১৯)
তাই অন্তহীন পরীক্ষার মুখোমুখি হলে আমাদের ভাগ্য মেনে নিতে হবে, আখিরাতের উপর ফোকাস করতে হবে, আল্লাহর পরিকল্পনার উপর ভরসা রাখতে হবে এবং ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। কষ্টের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পাওয়া এবং আল্লাহর রহমতের উপর আশা ধরে রাখলে আল্লাহর আমাদের শান্তি ও পুরস্কার দেবেন।
Leave a Reply