নবীদের জীবন থেকে সবচেয়ে সুখী হওয়ার পাঠ

পৃথিবীর বুকে যাঁরা বসবাস করেছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলেন নবীগণ। এটা ঠিক যে তাঁরা অন্য কারও চেয়ে বেশি কষ্ট সহ্য করেছেন। আল্লাহ তাঁদের যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের তীব্র নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। তা ছাড়া সাধারণ সব মানুষের মতো জীবন-যন্ত্রণাও তাঁদের ছিল। যেমন অসুখ, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি। তাঁদের কষ্টও হতো অন্যদের থেকে বেশি।

একবার হজরত মুহাম্মদ (সা.) এত তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন যে তাঁর কপাল ঘামে ভিজে গিয়েছিল এবং তিনি প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন। একজন সাহাবি তাঁকে বললেন, ‘আপনি প্রবল অসুখে ভুগছেন।’ নবীজি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি যখন অসুস্থ হই, তখন আমার কষ্টের তীব্রতা অন্য মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৬৫২)

এমনকি তিনি ক্ষুধারও শিকার হয়েছিলেন। একবার নবীজি (সা.) তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন এবং দেখলেন আবুবকর (রা) ও ওমর (রা.) বাইরে আছেন। তিনি তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই সময়ে তোমরা কী কারণে বাড়ি থেকে বের হলে?’ তাঁরা বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, ক্ষুধার কারণে।’ তিনি বললেন, ‘আমার জীবন যাঁর হাতে, সেই আল্লাহর কসম, আমিও সেই একই কারণে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২,৯৭৮)

দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে নবীদের সবাই আপন লোকদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তবে তাঁদের হৃদয় ছিল শক্ত। মানুষের প্রতি তাঁরা ছিলেন উদার এবং তাঁরা তাঁদের পরাজয় বিজয়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরেছিলেন। তাঁদের জীবনের সৌন্দর্য আশ্চর্যজনক।

তাঁরা যা সহ্য করেছিলেন, তা সত্ত্বেও তাঁরা অন্য যেকোনো মানুষের চেয়ে বেশি সুখ ও তৃপ্তির জীবন যাপন করেছেন। তাঁদের জীবনী সামনে রাখলে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা দেয়।
কষ্টের সঙ্গে সন্তুষ্টি
আমরা মহানবী (সা.)-এর জীবনে এই অসাধারণ সন্তুষ্টির উদাহরণ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই, এমনকি যখন তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখনো। তিনি তায়েফের মানুষের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। তাঁরা শুধু তাঁর আহ্বান কেবল প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা–ই নয়, তাঁকে পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য শহরের শিশু ও দুষ্টুদের লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি নিজের রক্তে ভিজে যাওয়া জুতা, রঞ্জিত ও ধুলামলিন দেহ নিয়ে শহর ছেড়েছিলেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শুরু করলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আমার দুর্বলতা, আমার সম্পদের অভাব এবং মানুষের সামনে আমার অপারগতার কথা জানাই।

হে সবচেয়ে দয়ালুদের সবচেয়ে দয়ালু, হে দুর্বলদের প্রভু এবং আপনি তো আমারও প্রভু, আপনি আমাকে কার কাছে সঁপেছেন? এমন লোকদের কাছে যাঁরা আমাকে শত্রু ভেবেছেন? নাকি এমন শত্রুর কাছে, যাঁদের আপনি আমার ওপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন? যতক্ষণ না আপনি আমার প্রতি ক্রোধান্বিত হন, ততক্ষণ আমি কারও পরোয়া করি না। আপনার অনুগ্রহ থাকলে আর কিছু চাই না। আমি আপনার চেহারার আলোতে আশ্রয় চাই, যার দ্বারা সব অন্ধকার দূর হয়। আমি শুধু আপনার সন্তুষ্টি চাই।’

পরীক্ষা ও সত্যিকারের বিশ্বাস
আল্লাহর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাসই হৃদয়ে এই ধরনের সন্তুষ্টি ও সুখ নিয়ে আসে। এর অর্থ এই নয় যে বিশ্বাসীর জীবন কাঁটামুক্ত হবে। আল্লাহ এই জীবনকে পরীক্ষার জন্যই দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য যে তোমাদের মধ্যে কারা সৎকর্মে উত্তম হবে।’ (সুরা মুলক: আয়াত: ২)

জীবন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী—উভয়ের জন্যই পরীক্ষা। পাপীদের জন্য যেমন পরীক্ষা, তেমনি পুণ্যবানদের জন্যও। যতক্ষণ তাঁরা জীবিত থাকবেন, পরীক্ষার ভেতরই থাকবেন। কিন্তু নবী-রাসুল ও কিতাব পাঠিয়েছেন শুধু পরকালে সুখ অর্জনের পথ দেখানোর জন্য নয়, বরং এই জীবনে শান্তি পাওয়ার জন্যও। তাই দেখা যায়, বিশ্বাসী ব্যক্তি এই দুনিয়াতেও সত্যিকারের সুখী জীবন যাপন করে। কেননা, সত্যিকারের সুখ কেবল আল্লাহকে বিশ্বাস এবং জ্ঞান থেকেই আসতে পারে।

সুতরাং নবীরা হলেন বিশ্বাসীদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং তাঁদের জীবনও ছিল সবচেয়ে সুখী ও শান্তিময়। আল্লাহর সন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *