খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা

খাদ্যনিরাপত্তা কেবল পেট ভরানোর বিষয় নয়, এটি মানুষের মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম। ইসলামি নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের খাদ্যের উপযোগিতা নিশ্চিত করা একটি ঐশী দায়িত্ব, যা পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আজকাল জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য খাদ্যসংকটকে তীব্র করে তুলেছে, ইসলামি নৈতিকতা এই সমস্যার সমাধানে একটি শক্তিশালী কাঠামো দিতে পারে।

ইসলামে খাদ্যনিরাপত্তা

ইসলামে খাদ্যকে আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে গণ্য করা হয়, যা কেবল ব্যক্তিগত প্রয়োজন নয়, সমাজের সবার জন্য সুলভ হওয়া উচিত। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করো এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত ১১৪)

এই আয়াতে খাদ্যের পবিত্রতা ও কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি এর প্রাপ্যতার বিষয়টি উঠে আসে। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে, সে আমার উম্মতের সদস্য নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩,২৬১)

 এই হাদিস খাদ্যনিরাপত্তাকে একটি সমষ্টিগত দায়িত্ব হিসেবে উপস্থাপন করে। ইসলাম শুধু ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাসে জোর দেয় না; বরং সমাজের দুর্বল গোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের নিশ্চয়তাকে একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করে।

খাদ্যনিরাপত্তা একটি মানবাধিকার

ইসলামি নৈতিকতা মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ৩২)

খাদ্যের অভাবে যদি কেউ জীবনযাত্রার মান হারায় বা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়, তবে তা এই নীতির পরিপন্থী। আধুনিক বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি–২: জিরো হাঙ্গার) একটি মূল উপাদান।

ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য জাকাত, সদকা ও ওয়াক্‌ফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, জাকাতের অর্থ দিয়ে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, যা পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আট শ্রেণির মানুষের মধ্যে দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য ব্যয় করার নির্দেশ দেয়। (সুরা তাওবা, আয়াত ৬০)

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। এ ছাড়া শহুরে–গ্রামীণ বৈষম্য ও দারিদ্র্যের কারণে দুর্বল গোষ্ঠী, যেমন দিনমজুর, ভাসমান জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা প্রায়ই খাদ্যসংকটের শিকার হন।

ইসলামি নৈতিকতা এ সমস্যার সমাধানে একটি ব্যবহারিক কাঠামো দিতে পারে। জাকাতের তহবিল কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ করে খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘দান করো, এমনকি তা একটি খেজুর হলেও। কেননা, তা ক্ষুধা নিবারণ করে এবং পাপকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুন নেভায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,০১৬)

এই নীতি অনুসরণ করে স্থানীয় মসজিদ ও সম্প্রদায়ের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।

ইসলামি ব্যবহারিক কাঠামো

ইসলাম দুর্বল গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহর ভালোবাসার জন্য দরিদ্র, এতিম ও বন্দীদের খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর, আয়াত ৮)

 এই গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও শরণার্থীরা। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি একজন ক্ষুধার্তকে খাওয়ায়, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২,০৩৬)

 খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইসলামি নৈতিকতা থেকে কিছু ব্যবহারিক নীতিমালা প্রয়োগ করা যেতে পারে:

১. জাকাতের কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশে জাকাতের তহবিল সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

২. খাদ্য অপচয় রোধ: পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৩১)। হোটেল ও বিয়ের অনুষ্ঠানে খাদ্য অপচয় রোধে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।

৩. টেকসই কৃষি: ইসলাম পরিবেশের সুরক্ষার ওপর জোর দেয়। জলবায়ু সহনশীল ফসল চাষ ও জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

৪. সামাজিক উদ্যোগ: মসজিদভিত্তিক খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা, যেখানে স্থানীয় সম্প্রদায় দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করবে।

সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকবে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে মানুষের জন্য কল্যাণকর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০২৬)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *