হতাশা মানে কি ইমান দুর্বল হওয়া

আজকের দ্রুতগতির, অনিশ্চিত ও জটিল বিশ্বে মুসলিমদের ইমান কি দুর্বল হয়ে পড়ছে? দুশ্চিন্তা, দুঃখ, উদ্বেগ ও হতাশার মতো আবেগ কি ইমানের দুর্বলতার প্রতিফলন? নাকি এগুলো আমাদের আধুনিক জীবনধারা ও সমাজের বাহ্যিক চাপের ফল? আসুন, ইসলামের আলোকে পথ খুঁজে বের করি।
মানসিক অসুস্থতা ইমানের দুর্বলতা নয়
মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা একে অপরের পরিপূরক। অনেকে মনে করেন, মুসলিম হিসেবে আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সংযোগ থাকলে মানসিক দুর্বলতা থাকার কথা নয়। কিন্তু এই ধারণা ভুল।

পবিত্র কোরআনে নবী ইয়াকুব (আ.)-এর ঘটনা আমাদের শেখায়, দুঃখ ও শোক মানুষের স্বাভাবিক আবেগ। তিনি তাঁর পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর কথা শুনে এতটাই শোকে কাতর ছিলেন যে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। (সুরা ইউসুফ: ১৮, ৮৪)

দুঃখ, উদ্বেগ বা হতাশা ইমানের অভাবের লক্ষণ বলা সঠিক নয়। দুঃখ বা উদ্বেগ ইমানের দুর্বলতা নয় বরং এগুলো মানুষের স্বাভাবিক অংশ। এই আবেগগুলোকে নিজেদের মতো বিচার না করে বিশেষজ্ঞের সাহায্যে মোকাবিলা করা উচিত।

বার্নআউটের যুগ
আধুনিক সমাজ, যাকে দার্শনিক বিয়ং-চুল হান বলেছেন ‘বার্নআউট সোসাইটি’, তা ক্রমাগত উৎপাদনশীলতা ও ইতিবাচকতার ওপর জোর দেয়। এই সমাজে বিরতি বা নেতিবাচক আবেগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে মানুষ ক্রমাগত চাপে থাকে, যা হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক ক্লান্তির কারণ হয়। হান বলেন, ‘এই সমাজে প্রত্যেকে নিজের উদ্যোক্তা, একই সঙ্গে শোষক ও শোষিত।’

এই অতিরিক্ত স্ব-অপ্টিমাইজেশন মানুষকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত করে, যার ফলে তারা অস্তিত্বের শূন্যতায় ভোগে।

চার্লস টেলর তাঁর বই এ সেক্যুলার এজ–এ ব্যাখ্যা করেন, পশ্চিমা সমাজ ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পরিবর্তন ঈশ্বর ও অদৃশ্য জগতের প্রতি বিশ্বাসকে প্রান্তিক করেছে, যা মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে আধুনিক জীবনধারা আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।

দুনিয়া সাময়িক ও পরীক্ষার ক্ষেত্র
ইসলাম দুনিয়াকে সাময়িক ও পরীক্ষার স্থান হিসেবে বর্ণনা করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এই দুনিয়ার জীবন কেবল সাময়িক সুখ, আর আখিরাতই চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯)

আবু জায়েদ আল-বালখি (৮৫০-৯৩৪ সাল) তাঁর বই মাসালিক আল আবদান ওয়াল আনফুস-এ বলেন, দুনিয়া এমন এক স্থান নয়, যেখানে সব ইচ্ছা পূরণ হবে বা কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই জীবন কাটবে। এটি উদ্বেগ, দুঃখ ও চ্যালেঞ্জের স্থান। পবিত্র কোরআন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহ সর্বদা এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের রব, অতি দয়াময়, পরম করুণাময়।’ (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ১-৩)

এই আয়াত আমাদের আশ্বাস দেয়, আল্লাহর রহমত আমাদের চারপাশে রয়েছে এবং আমরা কখনো একা নই।

দুনিয়ার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:

১. দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তারা মৃত্যুবরণ করবে এবং কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবে।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ১২-১৬)

২. দুনিয়া পরিশ্রমের মাধ্যমে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের স্থান। ‘হে মানুষ, তোমার প্রতিপালক পর্যন্ত (পৌঁছাতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে।’ (সুরা ইনশিকাক, আয়াত: ৬-৯)

৩. দুনিয়া আমাদের কর্মের পরীক্ষা নেয়। ‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদের মধ্যে কে সর্বোত্তম কাজ করে, তা পরীক্ষা করেন।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১-২)

ইমানের মাধ্যমে ভারসাম্য
শায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ রামাদান আল-বুতি বলেন, ‘যদি তুমি বিশ্বাস করো যে আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, দয়ালু এবং করুণাময়, তবে তুমি জানবে যে তিনি তোমার কল্যাণের জন্যই এই পরীক্ষা পাঠিয়েছেন।’

ইসলাম আমাদের শেখায়, আবেগগুলো স্বাভাবিক এবং এগুলোকে দমন না করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহর সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল বেশি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত বা ধর্মীয় পাঠে যোগদান নয়, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হবে। পবিত্র কোরআন আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়, ‘যারা ধৈর্য ধরে এবং বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব’, তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন এই দোয়া: ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ, অক্ষমতা ও অলসতা, কাপুরুষতা ও কৃপণতা, ঋণের ভার এবং মানুষের দ্বারা পরাভূত হওয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সহিহ বুখারি: ৬,৩৬৯; সহিহ মুসলিম: ২,৭০৬)

সূত্র: মুসলিম ডটএসজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *