হজযাত্রীদের জন্য আলেমদের মূল্যবান নির্দেশনা

ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে জাকাত একটি। এটি শুধু ধর্মীয় ইবাদতই নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। জাকাত শব্দটি আরবি। এর অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামে জাকাত হলো ধনীদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করা, যা সম্পদকে পবিত্র করে এবং সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করে।

জাকাতের ধারণা ইসলামের আগে থেকেই বিভিন্ন সমাজে বিদ্যমান ছিল। তবে ইসলামে এটি একটি সুসংগঠিত ও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) জাকাত ফরজ করা হয়। ইসলাম-পূর্ব সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে বিশাল ব্যবধান ছিল। ধনীরা তাদের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখত, আর গরিবরা চরম দারিদ্র্য ও অনাহারে জীবনযাপন করত। ইসলাম এই বৈষম্য দূর করতে জাকাতের বিধান চালু করে।

ইসলামি পণ্ডিত ইউসুফ আল-কারযাভী (রহ.) তার বই ইসলামের যাকাত বিধান-এ উল্লেখ করেছেন, প্রাচীন মিশর, ব্যাবিলন, গ্রিস ও স্পার্টার মতো সভ্যতাগুলোতে ধনীরা গরিবদের প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ দেখায়নি। গরিবদের জন্য উচ্ছিষ্ট বা তলানি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট রাখা হতো না। ইসলাম এই অমানবিক ব্যবস্থার বিপরীতে জাকাতের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠা করে।

জাকাত ফরজ হওয়ার পেছনে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কোরআনের সুরা জারিয়াতের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ১৯)

জাকাতের মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সম্পদকে পবিত্র করে এবং দাতার মনকে লোভ ও স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে। সুরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি তাদের সম্পদ থেকে সদকা আদায় করো, এর মাধ্যমে তুমি তাদের পবিত্র করবে।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১০৩)

জাকাত শুধু গরিবদের সাহায্য করাই নয়, এটি সম্পদকে বৃদ্ধিও করে। সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যা সুদে দাও, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জাকাত দান করে, তাদের সম্পদ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৩৯)

জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক, যাকে ইসলামি পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলা হয়। নিসাব হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সম্পদ কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ অর্থ বা সম্পদ। তবে এই পরিমাণ সম্পদ এক বছর থাকলে এর পরে জাকাত ফরজ হয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে একজন মুসলমানের ওপর তার সম্পদের ২.৫ শতাংশ হারে জাকাত দিতে হয়।

জাকাতের অর্থ সঠিক খাতে বণ্টন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পবিত্র কোরআনের সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে জাকাতের আটটি খাত উল্লেখ করা হয়েছে:

১. ফকির: যার কোনো সম্পদ নেই বা খুব সামান্য সম্পদ আছে।
২. মিসকিন: যার আয় তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
৩. আমিলিন: জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে নিয়োজিত কর্মচারী।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব: নব্য মুসলিম বা ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তি।
৫. রিকাব: দাসমুক্তির জন্য জাকাতের অর্থ ব্যবহার।
৬. গারিমিন: ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি।
৭. ফি সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর পথে জিহাদ বা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৮. ইবনে সাবিল: বিপদগ্রস্ত মুসাফির।

জাকাতের মাধ্যমে ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের চেষ্টা করে। এটি ধনী ও গরিবের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে। জাকাতের অর্থ গরিবদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়, যা সমাজের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখে।

জাকাত ইসলামের একটি মৌলিক বিধান, যা শুধু ধর্মীয় কর্তব্যই নয়, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক। জাকাতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়, দাতার আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং সমাজে দারিদ্র্য দূর হয়। এটি ইসলামের সার্বজনীনতা ও মানবতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। জাকাতের সঠিক প্রয়োগ একটি সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *