রমজান মানবতার পাশে দাঁড়ানোর মাস

রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাস মাহে রমজান। রমজানে ইবাদত, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত, কৃচ্ছ্রসাধন ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেবল পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না।

সেই সঙ্গে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে সর্বপ্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন, তবেই রোজা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত, বরকত ও মাগফিরাত।

রোজা এমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত যার মাধ্যমে মানুষ দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করতে পারে। এক মাসের সিয়াম সাধনার ফলে মানব মনের পাশব প্রবৃত্তি অবদমিত হয় এবং রুহ ও বিবেকের শক্তি শাণিত হয়। এক কথায়, রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়।

মহানবী (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস শুরু হয়, মহান আল্লাহ জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খিলিত করে রাখেন।’ যার কারণে ইবাদত, জিকির, কৃচ্ছ্রসাধন ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে, সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হইহুল্লোড় না করে। সমাজের কোনো সদস্য যদি তাকে গালাগাল করে বা তার সঙ্গে ঝগড়া করে সে যেন বলে- আমি রোজাদার’ (বুখারি ও মুসলিম)

রোজা ধৈর্য, সংযম, নৈতিক উৎকর্ষ ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্ম দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমজানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা। রমজান মাস আসলে মহানবী (সা.) সমাজের অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। এক মাস সিয়াম সাধনার ফলে সমাজের সদস্যদের উপকার ও কল্যাণের যে প্রশিক্ষণ রোজাদার পায়, তা বাকি ১১ মাস তার জীবনকে প্রণোদিত ও প্রভাবিত করে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো; সহমর্মিতা প্রদর্শন করো, আসমানের মালিক তোমার প্রতি দয়া পরবশ হবেন।’ এখানে জাতি, ধর্মবর্ণ ও গোত্র, নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি দয়া ও ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।

শুদ্ধতার এ অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন আর তাকওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবীর (সা.) ভাষায় ‘সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের মাস মাহে রমজান’ (বায়হাকি)। কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারাদিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জঠর জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন, ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়।

রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণের অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা! অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিও না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান করো। দরিদ্র মানুষকে ভালোবাস এবং কাছে টান। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।’

সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের বাকি জীবন যদি অনুশীলন করতে পারে, তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। রমজান মাস এলে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ। মহানবী (সা.) বলেন, ‘মজুতদার অভিশপ্ত।’

রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো সাদকাতুল ফিতর। প্রতিটি রোজাদারের জন্য নির্ধারিত পরিমাণে গম অথবা কিশমিশ অথবা খেজুর অথবা পনির অথবা এর বিনিময়ে নগদ অর্থ গরিব-দুঃখী ও অভাবক্লিষ্ট মানুষকে দান করা ওয়াজিব, তথা বাধ্যতামূলক। এতে করে রোজার ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো আল্লাহ মার্জনা করেন এবং অন্যদিকে সমাজের অসহায় মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। সম্পদশালী ও বিত্তবান যে কোনো মানুষের ওপর জাকাত ফরজ। জাকাত বছরের যে কোনো সময় প্রদান করলে আদায় হয়ে যাবে। তবে রমজান মাসে দান করলে তার সওয়াব বহুগুণ বেশি।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘মানবজাতির কল্যাণকর ও সৎ কাজে তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো। আর মন্দ, পাপ ও শত্রুতার কাজে পরস্পরের সহযোগিতা করো না।’

রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে অতি মানবীয় জীবনের দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে।

অতএব মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহ পাকের এক অপূর্ব নিয়ামত, যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে। মহান আল্লাহ সংযমের সঙ্গে মমত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার তাওফিক দান করুন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *