মিরাস থেকে মোহর ইসলামে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি!

সুরা নিসা পবিত্র কোরআনের চতুর্থ সুরা। “নিসা” শব্দের অর্থ স্ত্রীজাতি। এই সুরায় ২৪টি রুকু এবং ১৭৬টি আয়াত রয়েছে। এটি তৃতীয় হিজরিতে ওহুদ যুদ্ধের পর অবতীর্ণ হয়। সুরাটিতে উত্তরাধিকার, এতিমের অধিকার এবং নারীদের সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধান বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে।

পঞ্চম হিজরিতে মুসতালিক যুদ্ধের সময় পানির অভাব দেখা দিলে তায়াম্মুমের আদেশ জারি করা হয়, যা এই সুরায় উল্লেখ রয়েছে। এ সুরায় মুসলমানদের চরিত্র, আচরণ এবং সমাজব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে নারীদের সম্পর্কিত বিধানগুলো এতে বেশি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হওয়ায় সুরাটির নামকরণ করা হয়েছে “সুরা নিসা”।

রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর প্রাথমিক বছরগুলোতে সুরা নিসা নাজিল হয়। এর বেশিরভাগ অংশ বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ হয়। মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হওয়ার পর নবগঠিত রাষ্ট্রের কাঠামো ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয়। মুসলমানদের ইবাদত, আচার-আচরণ, সামাজিক ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। এ সময় ইসলামের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য শত্রুপক্ষ তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। মুসলমানরা ভৌগোলিক ও আদর্শিক সীমারেখা রক্ষার জন্য নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ঠিক এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে সুরা নিসা নাজিল হয়, যা মুসলিম সমাজকে দিকনির্দেশনা ও শক্তি প্রদান করে।

নারী ও পরিবার একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক, কিন্তু এটি একটি সুসংগঠিত ও মজবুত ভিত্তি। সুরা নিসায় এ বিষয়ে বিস্তারিত বিধান দেওয়া হয়েছে। জাহিলি যুগে নারীদের প্রতি যেসব অবিচার ও জুলুম চলত, সেগুলোর মূলোৎপাটন করা হয়েছে এই সুরায়। এ ছাড়া নারীদের অধিকার, পরিবার ও সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে এমন বহু বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে, যা সুরাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

সুরাটির সূচনায় তাকওয়া অর্জনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, এবং পুরো সুরাজুড়ে এর ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে। এতে কিছু বিশেষ বিধান উল্লেখ করা হয়েছে:

১. **এতিমদের সম্পদের অধিকার**: প্রাপ্তবয়স্ক হলে এতিমদের অর্থ-সম্পদ তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করা যাবে না। খারাপ বা নিম্নমানের সম্পদ দিয়ে তাদের ভালো বা মূল্যবান সম্পদ নিজে নেওয়া যাবে না। এ বিধান এতিম ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতিমদের সম্পদের প্রতি সদাচরণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।

২. **বিবাহ ও বহুবিবাহের বিধান**: ইসলামে একসঙ্গে চারজন নারীকে বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে এর জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে। স্বামীকে অবশ্যই তার স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে হবে এবং তাদের অধিকার পূর্ণভাবে আদায় করতে সক্ষম হতে হবে। যদি কেউ নিখুঁতভাবে এই শর্ত পূরণ করতে না পারে, তাহলে একজন স্ত্রী নিয়েই সন্তুষ্টচিত্তে সংসার করতে হবে। ইসলামের আগেও বহুবিবাহের প্রচলন ছিল, কিন্তু স্ত্রীর সংখ্যা সুনির্দিষ্ট ছিল না। ইসলাম এই সংখ্যা চারটিতে সীমাবদ্ধ করে এবং কঠোর শর্ত আরোপ করে, যাতে স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার নিশ্চিত করা যায়। বাস্তবে এই শর্তগুলো পূরণ করা এতটাই কঠিন যে, প্রকৃতপক্ষে একজন স্ত্রী নিয়েই সংসার করা নিরাপদ এবং উত্তম। জাহিলি যুগে আরবে অবাধে বহুসংখ্যক বিবাহের প্রচলন ছিল, কিন্তু ইসলাম তা নিয়ন্ত্রণ করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছে।

৩. **মোহরের বিধান**: বিবাহের সময় স্ত্রীকে মোহর প্রদান করা ফরজ। মোহর সাধারণত বিবাহের আগেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তবে স্ত্রীর সম্মতিক্রমে তা পরেও পরিশোধ করা যেতে পারে। মোহর নারীর অধিকার এবং তার মর্যাদার প্রতীক।

৪. **ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারের বিধান**: ইসলামে পুরুষ ও নারী উভয়েই ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী। সম্পত্তি বণ্টনের সময় উপস্থিত হলে বিরক্তি প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামে পুরুষদেরকে পরিবারের ভরণপোষণ, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এবং বিবাহের মোহরানাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণে পুরুষদের সম্পত্তিতে নারীদের তুলনায় বেশি অংশ দেওয়া হয়েছে।

৫. **নারীদের সম্পত্তির অধিকার**: ইসলামের আগে নারীদেরকে ওয়ারিশ বা মিরাস থেকে বঞ্চিত করা হতো। আরব সমাজে প্রচলিত ছিল যে, যারা ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারে না, তরবারি বহন করতে পারে না বা শত্রুর মোকাবেলা করতে পারে না, তাদের সম্পত্তি দেওয়া হবে না। এ কারণে শিশু ও নারীদেরকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হতো। ইসলাম এই অন্যায় ও জুলুমের অবসান ঘটিয়ে নারী ও শিশুদেরও সম্পত্তির হকদার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

৬. **নারীদের সঙ্গে সদাচরণ**: নারীদের সঙ্গে সদাচরণ এবং তাদের অধিকার রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তাদের প্রতি যেকোনো ধরনের অবিচার বা জুলুমের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে।

৭. **বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্ক**: সুরা নিসায় আত্মীয়তা, বৈবাহিক বা দুধসম্পর্কের কারণে যেসব নারীকে বিবাহ করা হারাম, তাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে (আয়াত: ২৩-২৪)। এই বিধানগুলো সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সুরা নিসা নারী, পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এবং ইসলামের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। এটি নারীদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথনির্দেশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *