মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

জহির উদ্দিন বাবর
গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন। ইসলামি ধারার সাহিত্য ও লেখালেখিতে এনেছেন নতুন মাত্রা। মাদ্রাসার জন্য প্রণয়ন করেছেন সংস্কারধর্মী সিলেবাস। ব্যক্তিগঠনে রাখছেন অনন্য ভূমিকা। প্রচারের আলোয় আসার বিন্দু পরিমাণ চেষ্টা ছাড়াই তিনি এদেশের মাদ্রাসাপড়ুয়া ও দীনদার শ্রেণির আস্থা ও ভালোবাসার মিনারে পরিণত হয়েছেন। তিনি মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ।
গত দুই তিন দশকে আলেম-উলামার কোনো সভা-সমাবেশে তার সরব উপস্থিতির কথা কেউ মনে করতে পারে না। মিডিয়া কাভারেজ কিংবা ফোকাসে আসার বিন্দু পরিমাণ চেষ্টা কেউ তার মধ্যে কোনোদিন লক্ষ করেনি। অথচ তিনি একজন সচেতন আলেম। সময়ের গতিপ্রবাহ তার নখদর্পণে। দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। জাতীয় পর্যায়ে আলেম সমাজের নেতৃত্বে আসীন হওয়ার সব যোগ্যতাই তার রয়েছে। কিন্তু তিনি এসবের ধার ধারেন না। সযতনে তিনি নিজেকে এসব থেকে আড়াল করে রাখেন। নীরবে-নিভৃতে নিজের কাজ নিজে করে যান। তিনি জীবনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন সেটা অর্জনেই তার পুরো মনোযোগ। সময়ের দরকারি কাজটি সম্পাদনের যে মিশন নিয়ে পথ চলছেন সেটাতেই নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছেন। দিন-রাতের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন শিক্ষকতা, লেখালেখি ও গবেষণামূলক কাজে। তবে তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও জাতি তাকে চেনে। তার অমরকীর্তির কথা জানে। আলেম-উলামা ও দীনদার শ্রেণির মধ্যে তাকে চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। তিনি মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ। আদিব হুজুর বলেও তার পরিচিতি রয়েছে।
একজন প্রাজ্ঞ আলেম, লেখক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও সংস্কারক হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তার। লেখক হিসেবে তিনি অনন্য। বাংলা সাহিত্যে গদ্যের একটি নিজস্ব ধারা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। যারা তার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচিত তারা জানেন তিনি লেখায় কতটা মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। আলেমদের মধ্যে তার মতো শক্তিধর কলমের অধিকারী খুব একটা নেই। তিনি শুধু নিজে লেখেননি, গড়ে তুলেছেন একদল লেখক। তার কাছে দীক্ষা নিয়ে লেখালেখির অঙ্গনে সরব অগণিত লেখক। তার প্রেরণা ও নির্দেশনামূলক লেখনী দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়নি- মাদ্রাসাপড়ুয়াদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। তিনি ‘মাদানি নেসাব’ নামে মাদ্রাসার একটি স্বতন্ত্র সিলেবাস প্রণয়ন করেছেন। এই সিলেবাসের সব বইই তার নিজের লেখা। বিভিন্ন মাদ্রাসা তার পুরো সিলেবাস কিংবা আংশিক অনুসরণ করে থাকে। দেশের নানাপ্রান্তে তার প্রণীত মাদানি নেসাব সংবলিত মাদ্রাসা গড়ে উঠছে। এক্ষেত্রে তার মতো এতটা স্বীকৃত ও জনপ্রিয় আলেমদের মধ্যে দ্বিতীয়জন আছেন বলে জানা নেই। তিনি বাংলাচর্চার পাশাপাশি এদেশে আরবি চর্চারও প্রাণপুরুষ। তার রচিত ‘এসো আরবি শিখি’ দেশের প্রায় প্রতিটি কওমি মাদ্রাসায় সিলেবাসভুক্ত। আরবি ভাষাকে ছাত্রদের বোঝার উপযোগী করে পড়ানোর পদ্ধতিও তার মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করেছে। একজন চিন্তাবিদ ও সংস্কারক হিসেবেও রয়েছে তার পরিচিতি। তার সংস্কার ও প্রেরণামূলক প্রতিটি লেখাই পাঠককে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহর জন্ম ১৯৫৬ সালের ৬ মার্চ। তার বাবার নাম মাওলানা মিছবাহুল হক। তিনি ছিলেন একজন দুনিয়াবিমুখ খোদাভীরু আলেম। তার মা ছিলেন একজন নেককার ও সম্ভ্রান্ত নারী। তার দেশের বাড়ি কুমিল্লায় হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। মায়ের কাছেই পড়াশোনার সূচনা। পরে তিনি ভর্তি হন জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসায়। সেখান থেকে তিনি কোরআনে কারিম হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর দরসে নেজামি পড়েন কামরাঙ্গীচরের নূরিয়া মাদ্রাসায়। এক পর্যায়ে আবার এসে ভর্তি হন লালবাগ মাদ্রাসায়। সেখানে হেদায়া জামাত সম্পন্ন করে চলে যান চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ১৯৭৭ সালে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন।
আদিব হুজুরের শিক্ষক জীবনের সূচনা হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায়। পরে কিছুদিন মালিবাগ জামিয়ায় পড়ান। এরপর তার একান্ত মুরব্বি মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের নির্দেশে নূরিয়া মাদ্রাসায় আসেন এবং দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৯২ সালে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসাতুল মাদিনা। সেখানে তিনি নিজের প্রণীত মাদানি নেসাবের পাঠদান শুরু করেন। কামরাঙ্গীরচর থেকে যাত্রা করা এই মাদ্রাসা এখন কেরানীগঞ্জের হজরতপুরে মনোরম পরিবেশে সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। মাওলানা মেসবাহ সেখানেই পাঠদান, গবেষণা এবং নিজের সাধনায় নিয়োজিত আছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের বড়ছেলে শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফের কন্যাকে বিয়ে করেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ নূরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক থাকাকালে ইকরা নামে আরবি পত্রিকা বের করতেন। পরবর্তী সময়ে এটি আল-কলম আরবি পত্রিকা নামে বের হয়। এছাড়া ১৯৯৯ সালে তার হাত ধরে সূচনা হয় বাংলা আল-কলম পত্রিকার। যা পুষ্প নামে পরিচিত এবং নবীন ও কচি-কাঁচাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। বর্তমানে কওমি মাদ্রাসায় লেখালেখির যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে এর পেছনে এই পত্রিকাটির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
মাদানি নেসাবের জন্য তার রচিত প্রথম পাঠ্যবই এসো আরবি শিখি, যা দেশে আরবি শেখার প্রাথমিক গ্রন্থ হিসেবে পঠিত হয়। তার রচিত অন্যান্য পাঠ্যবইয়ের মধ্যে রয়েছে এসো সরফ শিখি, এসো নাহু শিখি, এসো বালাগাত শিখি, এসো ফিকাহ শিখি, এসো উর্দু শিখি, ইসলামকে জানতে হলে, আত তামরিন, এসো তাফসির শিখি। এসো কোরআন শিখি তার লেখা উপমহাদেশের মাদ্রাসা ছাত্রদের কোরআন বিষয়ক প্রথম প্রাথমিক গ্রন্থ। আল মানার ও আল মুজামুল ওয়াসিত তার রচিত দুটি আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর লেখা মুসলমানদের পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, আরকানে আরবাআ, প্রাচ্যের উপহার, জীবনপথের পাথেয়, আল মুরতাজা, কাসাসুন নাবিয়্যিন অনুবাদ করেছেন। আল্লামা তাকি উসমানির লেখা মাযহাব কী ও কেন?, ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুআবিয়া (রা.) তার জনপ্রিয় অনুবাদ। গুরুদত্ত সিংয়ের রসুলে আরাবি তার হাতে ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ নামে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে তরুণ বয়সে তার হজের ভ্রমণকাহিনী বায়তুল্লাহর মুসাফির, বায়তুল্লাহর ছায়ায়, এসো কলম মেরামত করি, তুরস্কে তুর্কিস্তানের সন্ধানে ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে তার অনবদ্য সৃষ্টি। শিশু আকিদা সিরিজ, শিশু সীরাত সিরিজ ইত্যাদি তার শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। একটা লম্বা সময় তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও গবেষণামূলক কাজ করেছেন। সেখান থেকেও বেরিয়েছে তার বেশ কিছু বই।
আদিব হুজুর তার জীবনের একটি বড় অংশ ব্যয় করেছেন ব্যক্তি গঠনে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ব্যক্তি উদ্যোগে এমন কিছু যোগ্য আলেম তৈরি করেছেন, যারা তার মিশনকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করছে। দেশের আনাচে-কানাচে তার হাতেগড়া ছাত্ররা এখন দীনের দরকারি খেদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন। বাইরে তার বিচরণ কম হলেও ঘরোয়া পরিবেশে অনেকে তার নির্দেশনা দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকেন। তার সান্নিধ্য লাভের জন্য অনেকে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন। তিনি তাদের সময় দেন, চলার পথ নির্দেশ করেন। উম্মাহ দরদি একটি হৃদয় আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। ফলে তিনি উম্মতের ব্যথায় সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকেন। সামাজিক নানা অবক্ষয় ও অসংগতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। আর্তমানবতার সেবায়ও তার অবদান অনেক বেশি। তবে তিনি কখনো জানান দিয়ে এসব কাজ করেন না। কেউ জেনে যাক সেটাও তিনি চান না। ফলে সাধারণত তার এই গুণটি সম্পর্কে অনেকে জানেন না।
ব্যক্তি-দুর্ভিক্ষের এই সময়ে মাওলানা আবু তাহের মেসবাহর মতো সাধক আলেমের সংখ্যা খুবই কম। মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী ও মাওলানা সুলতান যওক নদভীর মতো মহান ব্যক্তিদের দীর্ঘ সান্নিধ্যে এই সাধক নিজেকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন। সাফল্যের শীর্ষ চূড়া স্পর্শ করে আজ তিনি নিজেই মহীরুহে পরিণত হয়েছেন। তিনি আজ এদেশের আলেম-উলামার বাতিঘর। তার বিকিরিত আলোয় আলোকিত লাখো মানুষ। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ুক দিগদিগন্তে, যুগ-যুগান্তরে; কীর্তিমান এই সাধক শতায়ু হোন- সেটাই একান্ত দোয়া ও প্রত্যাশা।
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ এর সকল বই পাচ্ছেন আমাদের কিতাবঘর.কম-এ। এখানে ক্লিক করুনঃ বই
Leave a Reply