শবে মেরাজ ও রজব মাস: যা না জানলেই নয়!

বাঙালীর ঐতিহাসিক শবে মেরাজ। এই শবে মেরাজ উপলক্ষে আমাদের সমাজে রজব মাস এবং শবে মেরাজের ফযীলত ও আমল নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক কাঁদা ছোড়া ছুড়ি হয়ে থাকে। তাই বিষয়টা উম্মতের সামনে খোলাসা হওয়ার প্রয়োজন মনে করছি। আকাবির ও আসলাফের তাহকিকের আলোকে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করব ইনশাআল্লাহ।
পাশাপাশি ‘রজব’ মাসের বিশেষ আমল ও শবে মেরাজ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিসের শাস্ত্রীয় ‘মান'(দালিলিক গ্রহনযোগ্যতা)নিয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
১.“জান্নাতে রজব নামে একটি নদী আছে।যার পানি দুধের মত সাদা।যে ব্যক্তি রজব মাসে রোজা রাখবে আল্লাহ পাক তাকে কেয়ামতের দিন ওই নদীর পানি পান করাবেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।” সুত্রঃ মকছুদুল মোমেনিন-২৪১ (রাহমানিয়া লাইব্রেরী)
এই রেওয়ায়েতটি সম্পুর্ন রুপে জাল।
দেখুনঃআল ইলালুল মুতানাহিয়া-২/৫৫৫ মিযানুল ই’তিদাল-৪/১৭৩ লিসানুল মিযান-৮/১৭০ ফয়যুল কাদির-২/৪৭০ আল মুগীর লি আহমাদ আল গুমারী-২৯ আল মুদাভী লি আহমাদ গুমারী-২/৩৬২
২.“যে ব্যাক্তি রজবের সাতাশ তারিখে রোজা রাখবে আল্লাহ পাক তার আমল নামায় ষাট মাস রোজা রাখার সওয়াব লিখে দিবেন।”
সুত্র-খোতবাতুল আহকাম-১৪৮
এই হদিসটি কোন সুত্রেই প্রমানিত নয়।
দেখুনঃআল আবাতিল ওয়াল মানাকির-৩৪৬-৩৪৭ আহাদিসু মুখতারা মিন মওযুআতিল জাওরাকানী ওয়া ইবনুল জাওযী লিয যাহাবী-৭৮ আলইলালুল মুতানাহিয়া-১/২২৬ আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-৭/৬৮০-৬৮১,১১/৭৪ তাবয়ীনুল আযাব ৩২,৪২-৪৫ জুযউ ইবনে আসাকির ৩১৬ শুয়াবুল ঈমান ৩/৩৭৩
৩. এছাড়া মশহুর আছে যে,”পনের রজব রাতে যে চৌদ্দ রাকাত নামাজ পড়বে।প্রতি রাকাতে একবার সুরা ফাতেহা এগারবার সুরা ইখলাস তিনবার সুরা নাস পাঠ করবে,এরপর সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,আল্লাহু আকবার,লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,ত্রিশবার করে পড়ে । আল্লাহ তায়ালা তাঁর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন।তার জন্য আকাশথেকে……….।”
এই বর্ননাটিও জাল।
আল্লামা ইবনুল জাওযী, জালালুদ্দিন সুয়ুতী, ইবনে ওয়াররাক কিনানী, আল্লামা তাহের পাটনী, মুহাম্মাদ বিন আলি আশ শাওকানী, আব্দুল হাই লাখনূভী রহ. প্রমুখ একে জাল বলেছেন।
দেখুনঃ কিতাবুল মউযুআত-২/৪৩৮-৪৩৯ তাবয়িনুল আযাব ২৭ আল লাআলিল মাসনুআহ-২/৫৭ তানযিহুশ শারিয়াহ -২/৯২ তাযকিরাতুল মাউযুআত-৪৪ আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ-৫০
মোটকথা , রজব মাসের নির্দিষ্ট কোন নামাজ বা রোজা নেই। এমাসে নির্দিষ্ট কোন দিনে নফল নামাজ বা রোজা পালনের বিশেষ কোন ফযিলতের কথা নির্ভরযোগ্য কোন হাদিসের দ্বারা প্রমানিত নয়।
অষ্টম শতকের বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী র. বলেন, “রজব মাসের নির্দিষ্ট কোন নামাজ প্রমানিত নেই।” আরও বলেন, “রাসুল সা. বা সাহাবায়ে কেরাম থেকে নির্দিষ্ট ভাবে রজব মাসে রোজা রাখার কোন ফযিলতের কথা প্রমানিত নয়।” সুত্র:লাত্বায়েফুল মাআরেফ-২২৮
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী র. বলেন “রজব মাসের ফযিলত,রজব মাসে রোজা রাখার ফযিলত,রজব মাসের নির্দিষ্ট কোন রাতে ইবাদত করার ফযিলত সম্পর্কে প্রমান হওয়ার উপযুক্ত কোন হাদিস নেই।” সুত্র:তাবয়ীনুল আযাব-১১ ফতহুল মুলহিম-৫/৩০৬-৩০৭(১১৫৭নং হাদিসের অধিনে)
৪.সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ২৭ ই রজবে ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হওয়ার কথাটাই ভিত্তিহীন।
এর কোনও প্রামানিক ভিত্তি নেই।
একটি ঐতিহাসিক বর্ননার আলোকে কথাটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কিন্তু তা আদৌ নির্ভর যোগ্য নয়। আল্লামা ইবনে কাসির, হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী, ইবনে নাসিরুদ্দিন দিমাশকি র. এর মত হাদিস বিশারদগন একে ভিত্তিহিন সাব্যস্ত করেছেন। তৃতীয় শতকের বিখ্যাত ইমাম শাইখ ইবরাহিম হারাবী র. ২৭ ই রজব মেরাজ হওয়াকে অস্বিকার করেছেন।
দেখুনঃ যাদুল মাআদ লি ইবনিল কায়্যিম আল জাওযি-১/৫৭-৫৮ লাতায়েফুল মাআরেফ লি ইবনে রজব আল হাম্বালী-২৩৩ জামিউল আছার লি ইবনে নাসিরুদ্দিন আদ দিমাশকি-৩/১৬-৫১ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া লি ইবনে কাসির-৩/৩৪০ আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ লিল ইমাম কাস্তালানী-৩/১৪ শরহুল মাওয়াহিব-৮/১৭-১৯ ইসলাহি খুতুবাত লি ত্বাকী উসমানী-১/৪৮-৫৫
মোট কথা,মেরাজের দিন তারিখ সম্পর্কে সাহাবা, তাবেয়ী ,ঐতিহাসিক কারও থেকেই নির্ভরযোগ্য কোন বর্ননা নেই। তাই এ বিষয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়।
কারন, রাসুল সা. বলেছেন,”যা শোনা তাই বলা(তাহকিক করে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া)মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।” সুত্র:সহীহ মুসলিম ,পৃ:৮ ও মেশকাত শরীফ।
মোদ্দাকথা হল,২৭ তারিখে শবে মেরাজ হিসেবে কোন ইবাদতে লিপ্ত হওয়া বিদ’আত ও গুনাহের কাজ। ২৭ তারিখে মেরাজ সংগঠিত হওয়াটাই ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত না। এছাড়া শবে মেরাজ উপলক্ষে কোন বিশেষ ধরনের আমল বা এই রাতে আমল করার কোন ফযীলতও শরীয়তে প্রমানিত না।
আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার তাওফিক দিন।
বিদআত মুক্ত সুন্নাহসম্মত জীবন যাপন করার তাওফীক দিন।
-মুফতি আফফান বিন শরফুদ্দিন
Leave a Reply