পুরুষের জন্য মেহেদি ব্যবহারের হুকুম

ইসলামি শরিয়তে মেয়েদের জন্য মেহেদি ব্যবহারের বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। মেয়েদের জন্য পায়ে মেহেদী ব্যবহার করাও জায়েয, আদব পরিপন্থী নয়। অনেকেই মেয়েদের পায়ে মেহেদি ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তি করে থাকেন। তাদের এসব আপত্তি ঠিক নয়।
আর পুরুষদের জন্য হাতে-পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা জায়েয নেই। তবে তারা চুল ও দাড়িতে ব্যবহার করতে পারবে। তবে বর্তমান সমাজে ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে মেহেদির ব্যবহার ব্যাপকভাবে পুরুষদের হাতসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেটা কখনোই কাম্য ছিল না।
শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষদের জন্য বিয়ের সময়ও হাতে-পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা জায়েয নেই। বরং সাজ-সজ্জার উদ্দেশ্যে তারা কখনও হাতে-পায়ে মেহেদী লাগাতে পারবে না। কারণ এটা এক ধরনের রঙ। আর পুরুষদের জন্য রঙ ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এমনকি ছোট ছেলে বাচ্চাদের জন্যও এটি নিষিদ্ধ।
• হাদিসে ইরশাদ হয়েছে
عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم طيب الرجال ما ظهر ريحه وخفي لونه وطيب النساء ما ظهر لونه وخفي ريحه
‘আবু হুরাইরাহ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পুরুষের সুগন্ধি এমন হবে যার সুগন্ধি প্রকাশ পায় কিন্তু রঙ গোপন থাকে এবং নারীর সুগন্ধি এমন হবে যার রঙ প্রকাশ পায় কিন্তু সুগন্ধি গোপন থাকে। (তিরমিযী হাদীস নং ২৭৮৭)
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, পুরুষ সাজসজ্জার জন্য রং ব্যবহার করতে পারবে না। আরো একাধিক হাদিসে অঙ্গসজ্জার জন্য পুরুষকে রং ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বরং তারা এমন প্রসাধনী ব্যবহার করবে যার ঘ্রান রয়েছে কিন্ত রঙ থাকবে না। যেমন আতর ইত্যাদি। আর নারীরা এমন প্রসাধনী ব্যবহার করবে যার রঙ থাকবে কিন্তু ঘ্রান থাকবে না। যেমন জাফরান, মেহেদি ইত্যাদি।
তবে পুরুষ চুল ও দাঁড়িতে মেহেদি ব্যবহার করতে পারবে। একইভাবে চিকিৎসার প্রয়োজনে পুরুষ মেহেদি ব্যবহার করতে পারবে—সেটা যে অঙ্গেই হোক না কেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪১; রদ্দুল মুহতার : ৬/৪২২)
• হযরত আবু হুরাইরাহ রাযি.থেকে বর্ণিত,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم أُتِيَ بِمُخَنَّثٍ قَدْ خَضَبَ يَدَيْهِ وَرِجْلَيْهِ بِالْحِنَّاءِ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ’’ مَا بَالُ هَذَا فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ يَتَشَبَّهُ بِالنِّسَاءِ . فَأُمِرَ بِهِ فَنُفِيَ إِلَى النَّقِيعِ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلاَ نَقْتُلُهُ فَقَالَ إِنِّي نُهِيتُ عَنْ قَتْلِ الْمُصَلِّينَ ‘‘
‘কোন একদিন এক হিজড়াকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আনা হলো। তার হাত-পা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গানো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ এর এ অবস্থা কেনো? বলা হলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! সে নারীর বেশ ধরেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে আন-নাকী নামক স্থানে নির্বাসন দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাকে হত্য| করবো না? তিনি বললেন, সালাত আদায়কারীদের হত্য| করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।’ [সুনানে আবু দাউদ- ৪৯২৮] বর্ণানাকারী আবু- উসামাহ বলেন, আন-নাফী’ হলো মাদীনাহ্ এর প্রান্তবর্তী একটি জনপদ, এটা বাকী’ নয়।
এই হাদিস থেকে জানা যায় যে, মেহেদি লাগানো নারীদের সৌন্দর্য ও বেশভূষা। পুরুষদের জন্য এটি অনুমোদিত নয়। এই নিষেধাজ্ঞা অন্য একটি হাদীস দ্বারাও সমর্থন করা হয়েছে।
• যেমন হযরত আনাস রাযি.থেকে বর্ণিতঃ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষদের জাফরানী রং লাগাতে (ও জাফরানি রংয়ের কাপড় পরতে) নিষেধ করেছেন। [বুখারী- ৫৮৪৬, মুসলিম-২১০১, আহমাদ ১২৯৪১]
হাফিজ ইবনে হাজার রহ. লিখেছেন: ‘পুরুষদের জন্য তাদের হাত-পা রং করা হারাম, তবে মেহেদি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।’ [ফাতহুল বারী ১০/৩৬৭]
• মেহেদীর সাজ মহিলাদের সাজ। হাদিস শরীফে এসেছে,
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: أَوْمَتْ امْرَأَةٌ مِنْ وَرَاءِ سِتْرٍ بِيَدِهَا، كِتَابٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَبَضَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَهُ، فَقَالَ: مَا أَدْرِي أَيَدُ رَجُلٍ، أَمْ يَدُ امْرَأَةٍ؟ قَالَتْ: بَلِ امْرَأَةٌ، قَالَ: لَوْ كُنْتِ امْرَأَةً لَغَيَّرْتِ أَظْفَارَكِ يَعْنِي بِالْحِنَّاءِ
‘হযরত আয়েশা রা. সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক মহিলা পর্দার আড়াল থেকে একটি কিতাব হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে বাড়িয়ে দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত না বাড়িয়ে বললেনঃ আমি বুঝতে পারছি না এটা কোনো পুরুষের হাত না কি নারীর হাত? সে বললো, বরং নারীর হাত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি মহিলা হলে অবশ্যই তোমার নখগুলো মেহেদীর রঙ দ্বারা রঞ্জিত করতে। [সুনানে আবু দাউদ-৪১৬৬]
উপরোক্ত হাদিস দিয়ে বুঝা গেলো, মেহেদী ব্যবহার করা এটা মহিলাদের সাজ। আর মহিলাদের সাজে সজ্জিত হওয়া পুরুষের জন্য হারাম। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সব পুরুষকে লা’নত করেছেন। যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে।’ [সহিহ বুখারী হা-৫৪৬৫]
• অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে
أن امرأة أتت عائشة رضي الله عنها فسألتها عن خضاب الحناء فقالت لا بأس به ولكني أكرهه كان حبيبي [ رسول الله ] صلى الله عليه و سلم يكره ريحه
এক মহিলা হযরত আয়শা রা. এর কাছে মেহেদি লাগানো বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বলেন, এতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু রাসূল সা. মেহেদির ঘ্রাণ অপছন্দ করতেন। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪১৬৪}
• ফাতাওয়ায়ে শামিতে এসেছে,‘পুরুষ তার হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগাতে পারবে না। কারণ এতে মহিলাদের সাথে সাদৃশ্যতা পাওয়া যাওয়ার কারণে তা মাকরুহ।’ [ফাতাওয়ায়ে শামি ৬/৪২২]
মিরকাতুল মাফাতিহে এসেছে,‘নারীদের জন্য হাত ও পায়ে মেহেদি লাগানো মুস্তাহাব।’ [মিরকাতুল মাফাতিহ ৮/৩০৪]
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরিতে এসেছে, ‘বিনাপ্রয়োজনে ছেলে বাচ্চাদের হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগানো জায়েয নয়। অবশ্য মেয়েরা ছোট হোক বড় হোক সৌন্দর্যের জন্য তাদের সকল অঙ্গে মেহেদী লাগাতে পারবে। এতে কোনো সমস্যা নেই৷’ [ফতওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৫৯]
• পুরুষদের জন্য চুল ও দাঁড়িতে ব্যবহার করা যাবে
তবে পুরুষেরা চুল ও দাঁড়িতে মেহেদী ব্যবহার করতে পারবে। কারণ হাদিস শরীফে হযরত আবু যার রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
‘যেসব জিনিস দিয়ে তোমরা বার্ধক্যকে পরিবর্তন করতে পারো তার মধ্যে মেহেদি ও কাতাম হলো সর্বোত্তম।’ [সুনানে নাসাঈ হাদিস: ৫০৭৮ আবু দাউদ: ৪২০৫ তিরমিযি: ১৭৫৩ ]
• চিকিৎসার জন্য মেহেদি ব্যবহার বৈধ:
তবে যদি কোন অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে পুরুষের জন্য মেহেদী ব্যবহার করা জায়েজ আছে। কারণ হাদিস শরীফে এসেছে,
‘আলী ইবনু উবাইদুল্লাহ রহ. হতে তার দাদীর সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবিকা ছিলেন। তিনি বলেন,‘যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহে কোন তলোয়ার বা দা-এর আঘাতে ক্ষত হতো, তিনি তাতে মেহেদী লাগানোর জন্য আমাকে নির্দেশ দিতেন।’ [জামে তিরমিযি-২০৫৪]
এজন্য ইমাম নববী রহ. বলেন,
‘মেহেদী পুরুষের জন্য ব্যবহার করা হারাম। তবে অসুস্থতা ও এ ধরণের অন্যান্য কোনো কারণে বৈধ।’ [আল মাজমুউ শরহুল মুহায্যাব ১/২৯৪]
• মেহেদী লাগানোর পর অযু করলে অযু হবে কি?
আমাদের দেশে বাজারে যেসব মেহেদীর প্রচলন রয়েছে যেমন গোল্ড মেহেদী বা টিউব মেহেদী এগুলো ব্যবহার করা জায়েয। এবং এগুলো ব্যবহার করে প্রলেপ উঠিয়ে ফেলার পর অযু-গোসল সবই সহীহ হবে।
কেননা এ মেহেদী লাগানোর পর শরীরে যে রঙ অবশিষ্ট থাকে যার কোনো কোনোটিতে পরবর্তীতে আবরণের মতো উঠে তা আমাদের জানামতে চামড়ায় পানি পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক নয়। তাই এগুলো ব্যবহার করতে সমস্যা নেই।
তবে যেসব মেহেদি চামড়ায় পানি পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয় সেগুলো ব্যবহার করা যাবে না। [শরহুল মুনয়া ৪৮; রদ্দুল মুহতার ১/১৫৪]
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮৯০; ফাতহুল বারী ১০/৩৬৭; রদ্দুল মুহতার ৬/৪২২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৭৩; সহীহ মুসলিম ২/১৯৯, আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ ২/৩৬৬, ফাতাওয়া খানিয়া আলা হামিশি হিন্দিয়া ৩/৪১৩; রদ্দুর মুহতার ৯/৫২২।
-মুফতি খাইরুল ইসলাম
Leave a Reply